স্বাগত ১৪২৪

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০৯:০৬

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


বাংলাট্রিবিউন:

শুভ নববর্ষ-১৪২৪‘নিশি অবসান প্রায় ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত/আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত/বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে রও, ক্ষমা কর আজিকার মত/পুরাতন বরষের সাথে পুরাতান অপরাধ যত।’

কালের অমোঘে বয়ে যায় সময়, পুরাতন বছর শেষে হাজির হয় নতুন বছর। আর এরই পরিক্রমায় বিদায় নিলো ১৪২৩, আগমন হলো নতুন বাংলা বছরের। শুভ বাংলা নববর্ষ, স্বাগত-অভিবাদন ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। বিপুল বৈভ্ব, সম্ভাবনা, নতুনের আহ্বান, পুরাতন দিনে হতাশা কাটিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বাঙালি। নতুন বছরে সবার আশা এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। যেখানে থাকবে না কোনও ভয়, হতাশা কিংবা অশুভ শক্তির।

হাজার বছরের বয়ে চলা লোকজ সংস্কৃতি আমাদের নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে। নতুন বছরের নতুন সূর্যোদয়ে নতুন কুড়ির মতো আমাদের সমাজ, জীবনে এবং রাষ্ট্রে সম্ভাবনার নতুন নতুন পালক যুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। তারা বলছেন, গত হওয়া বছরটির সব অপ্রাপ্তি ভুলে বাঙালি পথ চলবে সব ধরণের কুপমণ্ডুকতাকে পেছনে ফেলে। সব বাঁধার অতিক্রম করবে, যেমনটা করেছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের। সোচ্চার হবে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তাইতো বিশ্বকবির ভাষায় বলতে হয়, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচিহোকে ধরা।’

এ বিষয়ে গবেষক যতীন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রায় ৪শ’ বছর আগে মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে বঙ্গাব্দের সূচনা হয়। পরে খাজনা আদায়ের জন্য প্রচলন হয় বাংলা সনের। যার ধারাবাহিকতায় আসে হালখাতা। আর সেটিই এখন বাঙালির জীবনের প্রধানতম উৎসবের দিন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘আয়োজনে প্রতি বছর ভিন্ন রূপ ধারণ করে নতুন বর্ষ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রূপ প্রকাশ পায়। এ বছর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হবে। সূর্যের পেছনের অংশে থাকবে কালো রঙ। কালো রঙ-এর মাধ্যমে জঙ্গিবাদের অন্ধকার রূপকে তুলে ধরা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ মানে অন্ধকার। জঙ্গিবাদ অন্ধকারে নিতে চায়। সেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফিরতে সূর্য দিয়ে বোঝানো হচ্ছে। এ আহ্বান থাকবে মঙ্গল শোভাযাত্রায়। একই রকম ছোট ছোট অনেক সূর্য থাকবে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের হাতে। এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান থাকবে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের অংশ- আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।’

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বাঙালিরা পহেলা বৈশাখ পালন করে আসছে আবহমান কাল ধরে। তবে সময়ের বিবর্তনে পহেলা বৈশাখের ধরন ও ধারণ অনেক পাল্টেছে। এক সময় এটি শুধুই উৎসব ছিল, সেখানে অর্থনৈতিক একটা বিষয় ছিল। হালখাতা করা হতো, মেলা বসতো। একটা সময় দেখা গেছে, আমাদের স্বাধীনতার যে আকাঙ্ক্ষা ও বাসনা, সেটি পহেলা বৈশাখ ধারণ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আমরা দেখেছি, যেখানেই সাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশে ছোবল মারার চেষ্টা করেছে, তখন পহেলা বৈশাখ প্রতিবাদের ভাষায় পরিণত হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রাও একই চরিত্র ধারণ করে দিন দিন বিকশিত হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার সাজসজ্জায় দেখা যাবে, বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের চেহারা দেখেছি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় দেখেছি, স্বৈরাচারকে চিহ্নিত করে তার প্রতি ঘৃণা জানানো হয়েছে। আজও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির প্রতি ঘৃণা জানিয়ে সকলের মঙ্গল কামনা করে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইদানিং লক্ষ্য করছি, কিছু কিছু সাম্প্রদায়িক শক্তি নানাভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সমালোচনা করছে। তারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বন্ধ করার পাঁয়তারা করছে। পহেলা বৈশাখের এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে কোনও ধর্মের সংঘাত নেই। এটি একেবারেই সাংস্কৃতিক বিষয়। এখানে কোনও উপাসনা করা হয় না। কোনও পূজা অনুষ্ঠিত হয় না।’

সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ‘এবার পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিপুল উদ্দীপনার মধ্যে পালিত হবে। পহেলা বৈশাখের নানা উদ্যোগ কেবল সরকারের নয়। সাধারণ মানুষও নানাভাবে উদযাপন করছে। শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ নয়, সারাদেশে নানাভাবে পালিত হয়।’

বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক ও লোকগবেষক ড. সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘এই একটি দিনে নয়, পুরো বছর জুড়ে এভাবে বাংলাকে বাঙালি ধারণ করুক মনে প্রাণে। কেবল এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে যেন আমাদের এই বাংলাপ্রীতি সীমাবদ্ধ না থাকে। কারণ আমাদের প্রতিটি কাজে এখন কেবল ইংরেজির আধিক্য, তাই চাওয়া সব মতের সমান অধিকার যেন শিক্ষাক্রমে গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর কারিকুলামে যেন দেশজ সংস্কৃতির করিয়ে দেওয়া হয়।’

এদিকে, উন্নয়নসংস্থা ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমীন মুরশিদ বলেন, ‘গতবার মঙ্গলশোভাযাত্রায় নিরাপত্তার নামে শোভাযাত্রাকে সংকুচিত হয়ে যেতে দেখেছি। এবার যেন সেটি আরও বিস্তৃত হতে যাচ্ছে। নিরাপত্তার অবশ্যই প্রয়োজন কিন্তু সেটি যেন আমাদের ভয়ের কারণ না হয়। নতুন বছরে আমরা সব অসম্প্রদায়িক, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে পারি সে কামনা করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘দিনে দিনে মানুষের অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে যেটা এই বাংলায় কখনও ছিল না। ধর্মকে ব্যবহার করে এমন কিছু করা হচ্ছে যার সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই, যেটা ধর্ম সমর্থন করে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। তলোয়ার দিয়ে আমাদের দেশ কখনও ইসলাম প্রচার করা হয়নি। আমর চাই, ধর্মের নামে এসব সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিলু্প্ত হোক। বাংলাদেশ অসাম্প্রাদিয়ক দেশ, সেই চেতনা অক্ষুন্ন থাকুক।’